ভয়ঙ্কর সেই প্রদীপের এত অন্ধকার
ওসি প্রদীপ টেকনাফে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। কি মাদক ব্যবসায়ী আর কি-বা সাধারণ মানুষ, টাকাওয়ালা বুঝলেই তাদেরকে মাদক ব্যবসায়ী বলে আখ্যায়িত করে আটক বা জিম্মি করতেন। কথায় কথায় দিতেন ‘মেরিন ড্রাইভে’ নেওয়ার হুমকি। মেরিন ড্রাইভে নেওয়ার অর্থ মানেই ক্রসফায়ার! মাদক ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী পেলেই এভাবে হুমকি দিয়ে আদায় করতেন লাখ লাখ টাকা। আর যেসব মাদক ব্যবসায়ী চাহিদামতো টাকা দিতেন না তাদেরকেই দেওয়া হতো ‘ক্রসফায়ার’।
বৃহস্পতিবার মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে যাওয়া টেকনাফের সদ্য সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে এভাবেই স্থানীয় কয়েকজন অভিযোগ করেন। টেকনাফের স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছেÑ মেজর সিনহা হত্যা মামলায় আসামি হলে কক্সবাজারের আদালতে আত্মসমর্পণের পর গতকাল র্যাব তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়। এর আগেই বিকালে প্রদীপকে আদালতে হাজির করা হলে টেকনাফ থানার সামনে ভিড় জমান উৎসুক মানুষ। সেখানে প্রদীপের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে হয়রানি, নির্যাতনের শিকার একাধিক ভুক্তভোগীও জড়ো হয়েছিলেন। তারা সেখানে প্রকাশ্যেই সাবেক ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে গুরুতর নানা অভিযোগ করেন। অনেকেই বলেছেন, ক্রসফায়ারের আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা কামানোর মিশন পরিচালনা করছিলেন সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। গতকাল টেকনাফের অনেকেই তাদের নিজেদের ফেসবুক আইডি থেকে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের ব্যাপারে তদন্ত দাবি করেন। এরই মধ্যে একাধিক সংস্থা ওসি প্রদীপের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে বলেও জানা গেছে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মাঝিপাড়ার এক ভুক্তভোগী বলেন, বেশ কয়েকদিন আগে তার নিকটাত্মীয় রাজিয়া বেগম ও তার জামাইকে ওসি প্রদীপের নির্দেশে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যান টেকনাফ থানার এসআই সাগর ও এসআই সুদীপ। এরপর ওই পরিবারের কাছে তাদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তিন লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে এক লাখ টাকা দেওয়া হলেও ছেড়ে দেওয়া হয়নি। মাদক মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হাবিব উল্লাহ ওরফে হাবিবকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে টেকনাফ থানা পুলিশ। এরপর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা হাবিবকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিওতে হাবিবের স্ত্রী বলেছেন, বাসা থেকে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
টেকনাফের স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক গতকাল সময়ের আলোকে বলেন, টেকনাফের এই ভয়ঙ্কর ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় ‘কক্সবাজার বাণী’ পত্রিকার সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা। এরপরই নেমে আসে তার ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন। ক্রসফায়ারের ভয়ে রাতের আঁধারে কক্সবাজার থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসেন মোস্তফা। কিন্তু রক্ষা হয়নি। কোনো পরোয়ানা ছাড়াই ঢাকার পল্লবী থেকে তাকে ধরে নিয়ে টেকনাফ থানায় তিন দিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পরে মিথ্যা মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয় এই সাংবাদিককে। ফরিদুল মোস্তফার জীবনে এখন পঙ্গুত্ব দেখা দিয়েছে। স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতাও আজ অসহায়। চোখ প্রায় অন্ধ। ডান হাত ভাঙা ও আঙুল থেঁতলানো। ফলে মোস্তফা হয়তো আর সাংবাদিকতা করতেও পারবেন না।
ফরিদুল মোস্তফার স্ত্রী হাসিনা জানিয়েছেন, তার স্বামী বিভিন্ন সময় টেকনাফ থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছেন। এ কারণে তাকে ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। সে সময় তার চোখে মরিচের গুঁড়া দিয়ে নির্যাতন করায় বর্তমানে দুটি চোখই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ ছাড়া তার হাত-পা ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। চিকিৎসক জানিয়েছেন তার এক চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ওসি প্রদীপের সরাসরি তত্ত¡াবধানে থানায় একাধিক টিম বিভিন্ন জনকে টার্গেট করে মাঠে কাজ করত। মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে ‘ক্রসফায়ার’ বা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়সহ নানা অপকর্মে এসব টিমকে তিনি কাজে লাগাতেন। দেশব্যাপী মাদকবিরোধী কঠোর অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা থাকায় সেই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছেন ওসি প্রদীপ।
স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইয়াবার স্বর্গরাজ্য বা মূল গুদাম হিসেবে সবার কাছেই বেশ পরিচিত নাম কক্সবাজারের টেকনাফ। এখানে প্রতিনিয়তই চলে নিকটবর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে আসা কোটি কোটি টাকার ইয়াবার কারবার। আর এই বিপুল ইয়াবার কারবারের সঙ্গে টেকনাফের স্থানীয় বেশিরভাগ মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে সহজেই যে কাউকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে ফাঁসানো সহজ ব্যাপার ছিল।
জানা গেছে, গত দুই বছরে কক্সবাজার জেলায় দুই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। যার মধ্যে প্রায় ১৪৬ জনই টেকনাফের বলে জানা যায়। কেবল ক্রসফায়ারের ওপর ভিত্তি করেই প্রশংসনীয় ভ‚মিকা হিসেবে ২০১৯ সালে টেকনাফ থানার আলোচিত এই ওসি প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)’ পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি একাধিকবার পিপিএম পদকও পেয়েছেন। প্রদীপ প্রায় ২৫ বছরের চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তার গ্রামের বাড়িও চট্টগ্রামে। ২০১৮ সালে তিনি ওসি হিসেবে টেকনাফ থানায় যোগ দেন। এ বছরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বহু ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে এ থানা এলাকায়। সর্বশেষ ভিডিও বার্তায় তিনি চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন।