Please complete verification to access this content.
দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর বসানোর কাজ শুরু হওয়ার কথা আগামী মাসে। রাশিয়া থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের রিঅ্যাক্টরটি পাঠানোর প্রক্রিয়াও গত মাসে শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালে নির্ধারিত সময়েই উৎপাদন শুরু করতে পারবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগোলেও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি। এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, জরিপ ও কিছু নকশা তৈরি ছাড়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ তেমন একটা এগোয়নি। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, সঞ্চালন লাইন সময়মতো নির্মাণ না হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে বৃহৎ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখতে হবে। এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গুনতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
নির্ধারিত সময়ে গ্রিডলাইনের নির্মাণকাজ সম্ভব না হলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বিলম্বিত হতে পারে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ফুয়েল লোড করা হবে। তার আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই গ্রিড লাইনের কাজ শেষ করতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো রূপপুরকেও সঞ্চালন লাইনের জন্য বসিয়ে রাখতে হবে। এটি প্রকল্পের জন্য বড় একটি ধাক্কা। বিদু্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ রাশিয়ানরা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে ২০২৩ সালের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হবে। তবে গ্রিডলাইন সময়মতো হবে কিনা, তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। এটি নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। যদি ২০২২ সালের মধ্যে কোনো কারণে গ্রিডলাইন নির্মাণকাজ শেষ না হয়, তবে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে না। এটা হবে খুবই দুঃখজনক।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সময়মতো সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হলে তা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, পরিকল্পনার সময় সবসময় উৎপাদনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বিদ্যুতের ভ্যালু চেইনটা যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণ—কোনোটির গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু রিকল্পনাবিদরা সবসময় সঞ্চালনকে দ্বিতীয় অগ্রাধিকার দেন। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত হওয়ার পরও তা বসে থাকছে। সেক্ষেত্রে রূপপুরের একই অবস্থা হতে যাচ্ছে।তিনি বলেন, এত বড় একটি স্থাপনা প্রস্তুত হওয়ার পর সেটি যদি বসে থাকে তাহলে তার ক্ষতির অংকটা অনেক বেশি। বিপুল অংকের এ বিনিয়োগে যদি রাজস্ব না আসে তাহলে তার উদ্দেশ্যটাই বিফলে যাবে। রূপপুরের জন্য এ বছরও ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ অর্থের যথাযথ ব্যবহার যদি না হয়, তাহলে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সঞ্চালন লাইন নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর বড় একটি অংশ নির্মিত হচ্ছে ভারতীয় ঋণে। শুরুতেই প্রকল্পের ধীরগতি, ঋণের অর্থছাড় ও সর্বশেষ করোনা মহামারীসহ নানা কারণে প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দাবি করলেন, এখন পর্যন্ত সামগ্রিক অগ্রগতি হয়েছে ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে সংস্থাটিরই আরেকটি সূত্র বলছে, এ সঞ্চালন নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে শুরুতেই প্রায় দুই বছর কালক্ষেপণ হয়েছে। এছাড়া দরপত্রে বিলম্ব, পরামর্শক নিয়োগ ও এককভাবে কাজগুলো ভারতীয় বিনিয়োগকারী সংস্থা তত্ত্বাবধান করতে যাওয়ার কারণেও বিষয়টিতে বেশ বিলম্ব হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে গৃহীত প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল। বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। একনেকে অনুমোদনের এক বছর পর ২০১৯ সালের ২৬ মে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ নিয়ে চুক্তি সই হয়।
পিজিসিবির এক কর্মকর্তা জানালেন, একনেকে অনুমোদনের পর ঠিকাদার ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়ে গিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কার্যক্রমের অগ্রগতি আটকে ছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে শুধু চিঠি চালাচালিতে।
প্রসঙ্গত, সরকারি মালিকানাধীন রূপপুর পারমাণবিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে ভারতের ‘লাইন অব ক্রেডিট’ (এলওসি) চুক্তির সহায়তায়। ১০ হাজার ৯৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ৮ হাজার ২১ কোটি টাকা দিচ্ছে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। বাকিটার সংস্থান হচ্ছে সরকার ও পিজিসিবির নিজস্ব অর্থায়নে। প্রকল্পে ধীরগতি নামার পেছনে ভারতীয় ঋণসহায়তার শর্তগুলোকে দায়ী করেছেন অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিজিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের ঋণ হওয়ায় এখানে বেশকিছু শর্ত রয়েছে। বিশেষত লোকবল নিয়োগ, মালামাল ক্রয়, পরামর্শক নিয়োগসহ আরো বেশকিছু কাজ তাদের তত্ত্বাবধানে হবে। শর্তে ৭৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আমদানি করার কথা বলা হয়েছে। বাকি ২৫ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে স্থানীয়ভাবে এবং অন্যান্য দেশ থেকে। ফলে এ প্রকল্পে শর্ত পূরণ করাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে উপপ্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত কিউ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সম্প্রতি গতি এসেছে। প্রকল্প এলাকায় কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে টাওয়ার নির্মাণে ডিজাইন, রুট সার্ভে, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কাজ শেষ হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মাঠে টাওয়ার নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সমন্বয় করে এগিয়ে যাচ্ছি। কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার আগে বেশকিছু লাইনের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তবে পুরো লাইন শেষ হতে কিছুটা সময় বেশি লাগবে।