ঋণ পেতে ধাপে ধাপে শর্ত মানবে বাংলাদেশ

বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় ও বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতে চাইছে সরকার। এ ঋণের বিষয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চলেছে ধারাবাহিক বৈঠক। ঋণের বিপরীতে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, পর্যায়ক্রমে সেগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ঋণের বিষয়ে দর কষাকষি একপ্রকার চূড়ান্ত হয়েছে।

গতবুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ বৈঠকের পর আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ প্রাপ্তির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্রিফিং করা হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সার্বিক মূল্যায়ন তুলে ধরে পৃথক বিফ্রিং করবে আইএমএফ।

জানা গেছে, এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) কর্মসূচির আওতায় তিন কিস্তিতে দেড় বিলিয়ন ডলার করে এ ঋণ দিতে আগ্রহী আইএমএফ। তবে ঋণ পেতে নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্ধারণে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ, ব্যাংকের সুদ হারের সীমা প্রত্যাহার, বৈদেশিক মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার, খেলাপি ঋণ কমানো ও সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা। এর বাইরে ব্যাংক, আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজার সংস্কার, বন্ড বাজারের উন্নয়ন এবং কর ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ করে কর আদায় করার শর্তও রয়েছে।

শর্তযুক্ত এ ঋণের বিষয়ে আলোচনা করতে ১৫ দিনের সফরে গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় এসেছে সংস্থাটির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল। নেতৃত্বে আছেন রাহুল আনন্দ। এরই মধ্যে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ সিকউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), পেট্রোবাংলা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সঙ্গে বৈঠক করেছে দাতা সংস্থাটি। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এ সময় দুই ডেপুটি গভর্নর ও প্রধান অর্থনীতিবিদ উপস্থিত ছিলেন। এর পর বিকাল সাড়ে ৩টায় গভর্নরের সঙ্গে শেষ বৈঠক করে প্রতিনিধি দলটি। বৈঠকে সফরের সার্বিক পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক হয়েছে। আজ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সফরের শেষ বৈঠক। এ সময় সফরের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। ঋণপ্রাপ্তির বিষয়ে আমরা আশাবাদী।’

জানা যায়, সফর শেষে প্রতিনিধি দল আইএমএফের বোর্ড সভায় শর্তসংবলিত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরবে। সেটি অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ ঋণ পাবে। সে ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তির ১৫০ কোটি ডলার মিলবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। আইএমফের যত শর্ত ও পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি রয়েছে আইএমএফের। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, কোনো দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। বিশেষ করে রিজার্ভের অর্থে গঠিত ইডিএফসহ বিভিন্ন ঋণ তহবিল, যেগুলো নন-লিকুইড সম্পদ, সেটি রিজার্ভ থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করার কথা বলে আসছে আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে এই শর্তটি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামীতে তাদের শর্ত মেনেই রিজার্ভের হিসাব করতে সম্মত হয়েছে। চলমান হিসাব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ সাড়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি মানলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।

বাংলাদেশে এখন ব্যাংকে সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া আছে। বর্তমান পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আইএমএফ এই সীমা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি শুধু অতিরিক্ত অর্থপ্রবাহের কারণে না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনই ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার বিপক্ষে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে- বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে উৎপাদনমুখী শিল্পঋণে সুদহারের সীমা আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে সিএসএমই খাতে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। আইএমএফকে এ-ও জানানো হয়েছে, চলমান পরিস্থিতিতে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ির পর অনুৎপাদনশীল ভোক্তাঋণও নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

টাকা ও ডলারের ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার নিয়েও আপত্তি আছে আইএমএফের। তারা বলছে, ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কারণ এখন যেভাবে হচ্ছে, তাতে ডলারে বিনিময় হার নিয়ে বিভ্রান্তির আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করলেও এখন রেট নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকেই দেওয়া হয়েছে। বাফেদা ও এবিবি নিয়মিত বৈঠক করে এই রেট নির্ধারণ করছে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির উন্নতি চায় আইএমএফ। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে কি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আইএমএফ আরও বলছে, তিন মাস কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে খেলাপি ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করতে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পর অন্তত ছয় মাস সেটা অনিয়মিত ঋণ হিসেবেও প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এটি এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হু হু করে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। গত আগস্টের পর থেকে বিবিএস মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে বিলম্ব করে। মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে বিলম্বের কারণ জানতে চায় সংস্থাটি। এ ছাড়া জিডিপির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে রাজস্ব আদায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করে আইএমএফ। এ অবস্থায় রাজস্ব বাড়াতে কর অব্যাহতি কমানোসহ বিকল্প কর্মপরিকল্পনা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া রাজস্ব বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য সহায়তা চাইলে তা দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে আইএমএফ।

জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে সরকারের ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে বাজেটে মোট ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার ও কৃষি খাত অন্যতম। তবে ভর্তুকি কমানোর বিষয়টি পর্যায়ক্রমে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে আইএমএফকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
আইএমএফের অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে- সব খাতে করপোরেট সুশাসন আরও বলিষ্ঠ করা; বর্তমান অবকাঠামোর ওপর তদারকি আরও কঠোর করা এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ঋণদাতাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য আরও বলিষ্ঠ সহযোগিতা এবং ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিতের জন্য আইনি ব্যবস্থার যথোপযুক্ত সংস্কার করা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের রিজার্ভ যেভাবে নিচে নেমে গেছে, পাশাপাশি দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক যে প্রেক্ষাপট, তাতে করে আইএমএফের ঋণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যে শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই আমাদের নিজ উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। আইএমএফ বলছে, এ কারণেই যে করতে হবে, বিষয়টি তেমন নয়। আইএমএফ যে শর্তগুলো দিয়েছে, তার অনেকগুলোই বাস্তবসম্মত।

তিনি আরও বলেন, আমাদের রিজার্ভের হিসাবে গরমিল আছে। ডলারের ক্ষেত্রে যেমন বিভ্রান্তি রয়েছে। আজকে এক দর ঠিক করা হয়, আবার আরেকদিন বলা হয় বাজারে দাম বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের সমস্যাও অনেক পুরনো। এগুলো আমাদের নিজ উদ্যোগেই সমাধান করা উচিত।

ভর্তুকির মাত্রা খুব একটা কমানো যাবে বলে আমার মনে হয় না, মন্তব্যের পর তিনি যোগ করেন, কৃষক ও দরিদ্র মানুষ যেসব সেবা পায়, সেগুলোতে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে কোন খাতে কত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটার একটা সুষ্ঠু বিশ্লেষণ দরকার।
দরকষাকষি শেষ, ধাপে ধাপে শর্ত মানবে বাংলাদেশ আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তনসহ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়েছে বাংলাদেশ। অন্যান্য শর্ত ও পরামর্শও ধাপে ধাপে মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আইএমএফ থেকে মোট তিন কিস্তিতে ঋণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এজন্য আগামী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত শর্ত পূরণের সময় পাওয়া যাবে। এ সময়কালে ধাপে ধাপে সব শর্ত পূরণ করা হবে বলে আইএমএফকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ এর আগে আইএমএফের কাছে ঋণ চায় ১০ বার। প্রথমবার ঋণ নেয় ১৯৭৪ সালে। ঋণের জন্য সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গিয়েছে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সালে।

এদিকে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের কিছু শর্তের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিরুদ্ধে নিজস্ব নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। অন্যদিকে আইএমএফের ঋণ পেতে সবকিছু জলাঞ্জলি দেওয়ার পক্ষে নয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন বা এফবিসিসিআই।

Buy,Sale,Rent Property in Dhaka Bangladesh at ghorbareewala

Visit Ghorbaree Wala

Buy,Sale,Rent Property in Dhaka Bangladesh at ghorbareewala

Visit Ghorbaree Wala