শিক্ষক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি

ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান আর আইনে মাস্টার্স শেষ করে কলেজ শিক্ষক আর সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে তুলে এনেছিলেন রাজনীতির শীর্ষে, হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি।

তার ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ভারতের এক্সপ্রেস গ্রুপের সিনিয়র এডিটর জয়ন্ত রায় চৌধুরী বলছেন, প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও তিনি সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলেন।

তিনি বলেন, যখন খুব অসুবিধায় পড়েছেন যেমন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নিজে দল করার চেষ্টা করলেন, আবার ফিরলেন। সেই খারাপ সময় কাটাতে পেরেছেন কারণ তাঁর চেনাজানা। এতোটা গুরুত্ব ছিলো তাঁর সেজন্য কেউ তাকে আলাদা করতে পারেনি। বেশিদিন কেউ তাকে চেপে ধরে নামিয়ে রাখতে পারেনি।

প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার এক সাধারণ পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি।

পরে পাঁচ দশকের রাজনীতির পথ পাড়ি দিয়ে ২০১২ সালে ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যও আলোচনায় এসেছিলেন, তবে হতে পারেননি। তবে মেয়াদ শেষে অবসরের পর আর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি তিনি। জয়ন্ত বলছেন, বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কারণে প্রণব মুখার্জি পরিণত হয়েছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষকে।

তার মনে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কীভাবে পাল্টাচ্ছে, ভারত বা এশিয়ার জন্য তার তাৎপর্য প্রভাব কেমন হবে – এগুলো নিয়ে তার বিরাট দক্ষতা, এটা ছিলো তার বিরাট গুণ। উনি বিরাট একজন শিক্ষক। উনাকে না জিজ্ঞেস করে ইন্দিরা গান্ধী বা মনমোহন সিং কিছু করতেন না। এমনকি নরেন্দ্র মোদীও তার কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। সুতরাং উনি বড় রাজনীতিক সেটা সবাই জানে। কিন্তু তিনি যে বড় মাপের শিক্ষক সেটা সবার জানা নেই।

কিন্তু বাবার পথ ধরে শুরুতে রাজনৈতিক দল কংগ্রেসে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও স্থানীয় নেতারা তাকে সে সুযোগ দেননি। পরে কংগ্রেস থেকেই বেরিয়ে আসা অজয় মুখার্জীর বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর মেধা আর জ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে মি. মুখার্জী তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে পাঠান ১৯৬৯ সালে।

তার দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলছেন, মূলতঃ রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি আলো ছড়াতে শুরু করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পার্লামেন্টে তাঁর তৎপরতার মাধ্যমেই।

জয়ন্ত রায় চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই বড় কারণ প্রণব বাবুর জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশে। ইন্দিরা গান্ধী তার মেধায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে কংগ্রেসে নেন ও বড় বড় নেতাদের রেখে তাকেই নাম্বার টু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক সময় তাকে ইন্দিরা গান্ধীর মানসপুত্র বলা হতো। অতি অল্প বয়সে ১৯৮২ সালে তাকে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

তবে সেই কংগ্রেস থেকেও তাকে বেরিয়ে ভিন্ন দল করতে হয়েছিলো গান্ধী পরিবারের সাথে বিরোধের জের ধরেই। যদিও পরে আবারো ফিরে আসেন তিনি কংগ্রেসে। পাঁচবার রাজ্যসভায় গিয়েছেন আর লোকসভায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সালে, যা তাকে পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

নিজের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার আলোকে বই লিখেছেন অন্তত আটটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ে বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পেছনের ভূমিকাও উঠে এসেছিলো।

তবে ভারতে কংগ্রেসের বাইরেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাজনীতিতে বিশেষ মর্যাদায় তুলে এনেছিলো বলে মনে করেন লাহিড়ী।

তিনি বলেন, প্রণব মুখার্জী রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত জীবন উত্থানপতন ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। কংগ্রেস যখন ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে ওই সময় থেকে প্রণব ছিলেন রাজনৈতিক পরিপক্বতার তুঙ্গে ছিলেন। পরে তিনি অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি সবাইকে নিয়ে রাজনীতির চেষ্টা করেছিলেন বলে তাকে রাজনীতির চাণক্য নামে অভিহিত করা হয়।

লাহিড়ী বলেন, যে কোন সংকটময় মূহুর্ত থেকে উত্তরণে তার তৎপরতায় বারংবার ঋদ্ধ হয়েছে ভারতের রাজনীতি। কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়েই তিনি ভারতের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো এমনকি বিজেপি নেতাদেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।

লাহিড়ী ও জয়ন্ত রায় চৌধুরী দুজনেই বলছেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সমর্থন ও স্বীকৃতির জন্য অনবদ্য অবদান রাখা মি. মুখার্জীর অসীম মমতা ছিলো বাংলাদেশের প্রতি।

তবে গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ভারতের বাঙ্গালী রাজনীতিক হওয়ায় প্রণব মুখার্জী বরাবরই বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত নাম। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সাথে তৈরি হওয়া সম্পর্ক তিনি সযত্নে যেমন লালন করেছেন তেমনি দীর্ঘ সময় ভারতের অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে প্রতিবেশী বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে প্রভাব বিস্তারেরও সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

‘প্রণব মুখার্জি হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় বাঙ্গালি যিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ছাপ রেখেছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তার শ্বশুরবাড়ী বাংলাদেশে। সে কারণে একটা টান তাঁর থাকতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তিনি নানাভাবে সম্পৃক্ত। আবার শেখ হাসিনা নির্বাসনে থাকার সময় একটা পারিবারিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছিলো। আবার দীর্ঘকাল গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয় – অর্থ ও পররাষ্ট্র – তিনি চালিয়েছেন। সে কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিতেও তার ভূমিকা ছিলো’।

প্রণব মুখার্জি নিজেই তার বইয়ে বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে তার ভূমিকার কথা লিখেছেন যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো ২০১৭ সালে বইটি প্রকাশের পর। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই মি. মুখার্জিকে তার একজন পারিবারিক অভিভাবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক প্রণব মুখার্জির স্ত্রী প্রয়াত শুভ্রা মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। ১৯৯৬ সালে প্রণব মুখার্জি তার কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখার্জিকে নিয়ে শেষবারের মতো এই গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Buy,Sale,Rent Property in Dhaka Bangladesh at ghorbareewala

Visit Ghorbaree Wala

Buy,Sale,Rent Property in Dhaka Bangladesh at ghorbareewala

Visit Ghorbaree Wala